"আমাদের এই গল্পে দেখুন অভিজিৎ, এক জমিদার বাড়ির ছেলে, এবং অপর্ণা, এক গরীব ঘরের মেয়ের হৃদয়স্পর্শী গল্প। তাদের ভালোবাসা কি সমাজের বাধা অতিক্রম করতে পারবে? আর অভিজিতের বাবার মৃত্যুর পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্য কী? জানতে হলে দেখুন আমাদের সম্পূর্ণ গল্প - 'রায় মঞ্জিলের রহস্য'।"
প্রথম অধ্যায়: জমিদার বাড়ির ছেলে
চৈত্রের খটখটে দুপুরে আকাশটা যেন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। সেই আগুনের আঁচ এসে লেগেছে গঞ্জের জমিদার বাড়ি 'রায় মঞ্জিল'-এর উঠোনে। শত বছরের পুরোনো এই বাড়িটা যেন এক বিশাল বপু নিয়ে ঘুমিয়ে আছে, যার প্রতিটা ইটে জড়িয়ে আছে অসংখ্য গল্প। বাড়ির উত্তর দিকের বারান্দায় বসে একমনে ছবি আঁকছিল অভিজিৎ রায়। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, এলোমেলো চুল, মুখে একরাশ উদাসীনতা। তুলির প্রতিটা আঁচড়ে যেন সে নিজের মনের গভীর বেদনাকে ফুটিয়ে তুলছে। অভিজিৎ, এই বিশাল জমিদার বাড়ির একমাত্র উত্তরসূরি, যার কাছে ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি সবই তুচ্ছ। তার মনটা পড়ে থাকে শিল্পে আর ভালোবাসায়।
হঠাৎ পেছনের দরজা দিয়ে এসে ঢুকল অভ্র। অভিজিতের একমাত্র বন্ধু। অভ্র আর অভিজিৎ একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অভ্র প্রাণবন্ত, চঞ্চল আর বাস্তববাদী। অন্যদিকে অভিজিৎ শান্ত, ধীর এবং স্বপ্নের জগতে বাস করে।
"এই চুপ করে আছিস কেন? গালে হাত দিয়ে কী ভাবছিস? ফোন করবি না?" - অভ্রর কথায় চমকে উঠল অভিজিৎ।
অভিজিৎ মৃদু হাসল, "কী হয়েছে? তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে।"
অভ্র অভিজিতের পাশে এসে বসল, "আর বলিস না। ওই যে নতুন কলোনিটা হয়েছে, জানিস তো? ওখানে এক নতুন পরিবার এসেছে। মেয়েটা কী মিষ্টি রে!"
অভিজিতের ছবি আঁকায় মন ছিল, তাই সে অভ্রর কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না। "তো? তুই তো এমন কত মেয়ে দেখিস। তোর তো প্রতিদিনের নতুন কাহিনী।"
"আরে না, তুই ওকে দেখিসনি। ওকে দেখলে তোরও মাথা খারাপ হয়ে যাবে। নাম শুনেছি অপর্ণা। কী সুন্দর নাম!"
অভিজিৎ কোনো উত্তর দিল না। সে তার ছবিটা শেষ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অভ্র নাছোড়বান্দা। "চল না, একবার গিয়ে দেখে আসি। আমার সঙ্গে চল।"
অভিজিৎ বলল, "আমার এখন ছবি আঁকার মুড। তুই যা। আমি যাব না।"
অভ্র হতাশ হলো না। সে অভিজিতের হাত ধরে টানতে লাগল। "আরে চল না! একটু হেঁটে আসবি। তোর এই ছবি আঁকার রোগটা কমাতে হবে। সারাদিন বসে বসে ছবি আঁকিস, তাতে কী হয়?"
অভিজিৎ হেসে বলল, "আমার যা হয়, তাতে তো তোর কিছু যায় আসে না। আর আমার এই রোগটা সারে না। এটা আমার নেশা।"
অভিজিৎকে জোর করে টেনে নিয়ে চলল অভ্র। জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাচীর পেরিয়ে ওরা দুজন বের হল গ্রামের রাস্তায়। গঞ্জের বাজারের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে তারা এগিয়ে চলল। চারপাশে গাছপালা, বাঁশ বাগান আর কাঁচা মাটির বাড়ি। গ্রামের শান্ত পরিবেশ অভিজিতের খুব প্রিয়। চলতে চলতে তারা পৌঁছাল নতুন কলোনিতে। এখানে ছোট ছোট ঘর, সামনে উঠোন। একটা ঘরের সামনে বেশ কয়েকজন শিশু খেলা করছে। তাদের মাঝে এক তরুণী বসে আছে। পরনে সাদা শাড়ি। হাতে একটা বই। মেয়েটির মুখটা শান্ত, নিষ্পাপ।
অভ্র অভিজিতের কানে কানে বলল, "ওই দেখ, ওই মেয়েটা। কী সুন্দর তাই না?"
অভিজিৎ মাথা তুলে তাকাল। তার চোখে তখন কোনো মুগ্ধতা ছিল না, ছিল একরাশ কৌতূহল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সে যেন কোনো নতুন ক্যানভাস দেখতে পাচ্ছিল। এক মুহূর্তে তার তুলি, রং সব যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। অভিজিৎ ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল। অভ্র বলল, "কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?"
অভিজিৎ কোনো কথা বলল না। তার চোখ তখনও অপর্ণার দিকে। অপর্ণাও তাদের দিকে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হতেই অভিজিৎ চোখ নামিয়ে নিল। অভ্রকে বলল, "চল, এখান থেকে যাই।"
অভ্র অবাক হল। "এইটুকু দেখে চলে যাবি? তুই তো এমন করিস না!"
"চল, পরে আসব," অভিজিৎ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
তারা যখন ফিরে আসছে, তখন অভিজিতের মনে শুধু অপর্ণার মুখটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। অপর্ণার চোখের সেই অদ্ভুত কৌতূহল, যা অভিজিৎকে এক অজানা অনুভূতির জগতে ঠেলে দিল।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ক্যানভাসে আঁকা মুখ
এরপর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল, কিন্তু অভিজিতের মন থেকে অপর্ণার মুখটা কিছুতেই মুছল না। তার ছবি আঁকার ক্যানভাসে এখন কেবলই সেই মুখটা। শান্ত চোখ, নির্লিপ্ত হাসি আর একরাশ সরলতা। প্রতিটা তুলির আঁচড়ে যেন সে অপর্ণাকে আরও বেশি করে আবিষ্কার করছিল। অভ্রর সঙ্গে দেখা হলেই সে জিজ্ঞেস করে, "কিরে, অপর্ণাকে দেখেছিস?"
অভ্র হাসে, "তোর তো দেখছি রোগটা ধরেছে। আমি তো তখন বলেছিলাম। যাক, এবার অন্তত তোর ছবি আঁকার বাইরেও কিছু একটা নেশা হলো।"
অভিজিৎ কোনো উত্তর দেয় না, শুধু হাসে। সে জানে এই অনুভূতির কোনো নাম নেই। এটা শুধু এক কৌতূহল যা তাকে অপর্ণার কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
এক বিকেলে অভিজিৎ তার ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের সেই পুরোনো নদীটার ধারে গিয়ে বসা, যেখানে সে নির্জনে সময় কাটাতে ভালোবাসে। পথেই তার চোখ পড়ল অপর্ণার ওপর। অপর্ণা নদীর ধারে বসে একটি ঝুড়ি বুনছে। তার পাশে আরও কিছু মেয়ে আর ছেলে বসে আছে, তারা সবাই গল্প করছে আর হাসছে।
অভিজিৎ একটু দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে দেখল অপর্ণা সবার থেকে আলাদা। সে চুপচাপ নিজের কাজ করছে, কিন্তু তার চোখে মুখে একটা অন্যরকম শান্তি খেলা করছে। অভিজিতের মনে হলো, এই মেয়েটা সাধারণ নয়। তার ভেতরে কিছু একটা গভীরতা আছে, যা তাকে আকৃষ্ট করছে।
হঠাৎ একটা ছোট্ট ছেলে দৌড়ে এসে অভিজিতের সামনে পড়ল। ছেলেটা নদীর ধারে খেলা করছিল। "দাদা, কী দেখছেন?" - ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।
অভিজিৎ অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকাল। তার হাতে একটা পুরোনো খেলনা গাড়ি। অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, "তুমি এখানে কী করছ?"
ছেলেটা বলল, "আমি খেলতে এসেছিলাম। ওই যে দিদিটা আছে, ওর নাম অপর্ণা। ও খুব ভালো। আমাদের গল্প শোনায়।"
অভিজিৎ হাসল। সে বুঝতে পারল এই ছেলেটা অপর্ণার খুব কাছের কেউ। অভিজিৎ ছেলেটাকে নিজের কাছে ডাকল। "তোমার নাম কী?"
"আমার নাম রনি।"
অভিজিৎ তার পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে রনিকে দিল। রনি খুব খুশি হয়ে চকলেটটা নিল। তারপর অভিজিৎকে জিজ্ঞেস করল, "দাদা, আপনি এখানে ছবি আঁকেন?"
অভিজিৎ মাথা নাড়ল। "হ্যাঁ, আঁকি।"
"আপনি কি আমার ছবি আঁকবেন?" - রনি জিজ্ঞেস করল।
অভিজিৎ হাসল, "এখন নয়, অন্য একদিন।"
এই কথোপকথনের মাঝে অপর্ণা তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বুঝতে পারছিল অভিজিৎ একজন শিক্ষিত মানুষ, হয়তো জমিদার বাড়ির ছেলে। তার চেহারা আর পোশাক-আশাক সেই কথাই বলছিল। অপর্ণার মনে একটা অদ্ভুত কৌতূহল জন্ম নিল। কেন এই ছেলেটা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে? সে কি তাদের কলোনির কাউকে চেনে?
অভিজিৎ রনিকে বিদায় দিয়ে নদীর ধারে তার নিজের জায়গায় চলে গেল। সে তার ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করল। এবার সে অপর্ণার একটা নতুন রূপ দেখতে পেল। সে শুধু তার মুখ আঁকল না, তার চারপাশের পরিবেশ, নদীর শান্ত জল, গাছের সবুজ পাতা সব কিছু মিলিয়ে এক নতুন ছবি তৈরি করতে চাইল।
ছবি আঁকতে আঁকতে অনেকটা সময় কেটে গেল। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ঠিক তখন অপর্ণা তার ঝুড়ি নিয়ে একা ফিরে যাচ্ছিল। সে দেখল অভিজিৎ তখনও ছবি আঁকছে। অপর্ণা অভিজিতের দিকে এগিয়ে গেল।
"নমস্কার। আপনি কি ছবি আঁকতে ভালোবাসেন?" - অপর্ণা জিজ্ঞেস করল।
অভিজিৎ চমকে উঠল। সে কখনও ভাবেনি অপর্ণা নিজে থেকে তার সঙ্গে কথা বলতে আসবে। সে অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়াল। "হ্যাঁ, ভালোবাসি।"
"আপনি খুব সুন্দর ছবি আঁকেন।" - অপর্ণা বলল।
অভিজিৎ হাসল, "ধন্যবাদ।"
"আমি আপনার ছবিটা দেখতে পারি?" - অপর্ণা জিজ্ঞেস করল।
অভিজিৎ ক্যানভাসটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিল। অপর্ণা অবাক হয়ে দেখল ছবিতে তার নিজের মুখ আঁকা। শুধু তার মুখ নয়, তার চারপাশের প্রকৃতিও তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার চোখে মুখে একরাশ বিস্ময়।
"আপনি... আপনি আমার ছবি আঁকলেন?" - অপর্ণা ফিসফিস করে বলল।
অভিজিৎ মাথা নামিয়ে বলল, "আমি জানি না কেন, কিন্তু আপনার মুখটা আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। আমি আপনার মধ্যে অনেক গভীরতা খুঁজে পাই।"
অপর্ণা আর কোনো কথা বলল না। সে অভিজিতের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি হাসল, যার মধ্যে ছিল হাজারো না বলা কথা। সেই হাসি অভিজিতের হৃদয়ে এক নতুন ঢেউ তুলল।
তৃতীয় অধ্যায়: এক গোপন সম্পর্ক
অপর্ণার সেই মৃদু হাসি অভিজিতের মনকে এক নতুন দিকে চালিত করল। সেদিন থেকে তাদের মধ্যে একটা নীরব সম্পর্ক তৈরি হলো। প্রায় প্রতিদিনই অভিজিৎ নদীর ধারে যেত, তার ক্যানভাস আর তুলি নিয়ে। অপর্ণাও তার ঝুড়ি বুনতে বা বই পড়তে আসত। তাদের মধ্যে খুব বেশি কথা হতো না, কিন্তু তাদের চোখাচোখিই যেন হাজারো কথা বলত।
একদিন অভ্র এসে অভিজিৎকে নদীর ধারে দেখে অবাক হলো। "কিরে, তুই এখানে কী করছিস? তোর না ছবি আঁকার মুড নেই?"
অভিজিৎ হাসল। "মুড তো সব সময় থাকে না, তবে আঁকতে তো পারি।"
অভ্র অভিজিতের ক্যানভাসের দিকে তাকাল। দেখল, সেখানে একজন মেয়ের ছবি আঁকা। অভ্রর মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল। "এই না সেই অপর্ণা? তোকে বলেছিলাম না? তুই তো দেখেই প্রেমে পড়ে গেছিস! আমাকে তো কিছু বলিসনি।"
অভিজিৎ চুপ করে রইল। সে জানে অভ্রর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। অভ্র সব কিছুকেই মজা করে নেয়।
"তোর বাবা-মা জানেন? তোর বাবা শুনলে কী বলবেন?" - অভ্রর কথায় অভিজিতের মনটা ভারি হয়ে গেল।
হ্যাঁ, সে জানত তার বাবা, জমিদার রায়বাহাদুর, এই সম্পর্কটা কোনোদিন মেনে নেবেন না। জমিদার বাড়ির ছেলে হয়ে গ্রামের এক সাধারণ মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করা! এটা তার কাছে ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু অভিজিৎ কিছুতেই তার মনকে বোঝাতে পারছিল না। তার কাছে অপর্ণার সেই শান্ত মুখ, সেই হাসিটাই ছিল সব।
অভিজিৎ অভ্রকে বলল, "চল, এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।"
এক সন্ধ্যায় অভিজিৎ আর অপর্ণা নদীর ধারে বসে গল্প করছিল। তাদের গল্পে ছিল না কোনো আভিজাত্য, ছিল শুধু একে অপরের প্রতি এক গভীর টান। তারা একে অপরের স্বপ্ন, আশা আর ভয় নিয়ে কথা বলছিল।
অপর্ণা বলল, "আমার বাবা-মা গরিব মানুষ, তারা শুধু চান আমি যেন সুখে থাকি। তারা চান আমি যেন পড়াশোনা করে একজন ভালো মানুষ হই।"
অভিজিৎ বলল, "আমিও তাই চাই। আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই, কিন্তু আমার ভয় হয়। আমার বাবা... তিনি হয়তো এই সম্পর্কটা মেনে নেবেন না।"
অপর্ণা হাসল। "আমিও জানি। আমাদের সমাজের নিয়মগুলো খুব কঠিন। কিন্তু আমরা যদি একে অপরের পাশে থাকি, তাহলে কি আমরা পারবো না?"
অভিজিৎ অপর্ণার হাত ধরল। "আমরা পারবো। আমি কথা দিচ্ছি।"
তাদের এই গোপন সম্পর্কটা গ্রামের কয়েকজনের চোখে পড়ল। জমিদার বাড়ির ছেলে আর গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ের এই সম্পর্কটা নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলো। একদিন এক গ্রামবাসী অভ্রকে ডেকে বলল, "এই অভ্র, তুই তো রায়বাবুর ছেলের বন্ধু। ওকে বল, সে যেন আর ওই মেয়ের সঙ্গে না মেশে। লোকে নানা কথা বলছে।"
অভ্র অভিজিৎকে এসে সবটা বলল। অভিজিৎ শুনে খুব রেগে গেল। "লোকে কী বলছে, তাতে আমার কী যায় আসে? আমি যা করছি, তা ঠিক।"
অভ্র বলল, "কিন্তু তোর বাবা যখন শুনবেন?"
অভিজিতের মনে তখন শুধু একটাই কথা, তার বাবা যেন এই সম্পর্কের কথা কোনোদিন জানতে না পারেন। কিন্তু নিয়তির খেলা অন্যরকম।
চতুর্থ অধ্যায়: এক গোপন চিঠি আর ভাঙা স্বপ্ন
শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে চারপাশ। জমিদার বাড়ির বাগানে বসে ছিল অভিজিৎ। তার হাতে একটা চিঠি। এই চিঠিটা সে অপর্ণাকে দেবে। তাতে লেখা আছে তার মনের সব কথা, তাদের ভালোবাসার গভীরতা আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। অভিজিৎ চিঠিটা নিজের হাতে লিখেছে, তার মনের সবটুকু আবেগ দিয়ে।
ঠিক তখনই তার বাবা, রায়বাহাদুর, এসে তার সামনে দাঁড়ালেন। রায়বাহাদুরের চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি। তার হাতে একটা কাগজ। "অভিজিৎ, এটা কী?" - তিনি গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
অভিজিৎ চমকে উঠল। সে জানে না তার বাবা কীসের কথা বলছেন। কিন্তু তার বুক কেঁপে উঠল। তার মনে হলো, কোনো এক অশুভ শক্তি যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে।
রায়বাহাদুর কাগজটা অভিজিতের দিকে ছুড়ে দিলেন। "এই কাগজটা দেখ। এটা কে পাঠিয়েছে?"
কাগজটা ছিল একটা পুরোনো খবরের কাগজের অংশ। তাতে লেখা, "জমিদার বাড়ির ছেলে অভিজিৎ রায় আর গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে অপর্ণার গোপন প্রেমের সম্পর্ক ফাঁস।" এই সংবাদে অভিজিতের নাম আর অপর্ণার নাম উল্লেখ করা আছে, এবং তাদের ছবিও আছে। অভিজিৎ অবাক হয়ে তাকাল। এই খবরটা কে ছড়াল? আর কেন?
অভিজিৎ বাবার দিকে তাকাল। "বাবা, এটা... এটা কী?"
রায়বাহাদুর গম্ভীর স্বরে বললেন, "আমি জানি না এটা কী। কিন্তু আমি চাই না আমার বংশের কোনো সম্মান নষ্ট হোক। আমি জানি না এই মেয়েটা কে, কিন্তু আমি চাই না তুই আর তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখিস।"
অভিজিৎ বলল, "বাবা, আমি অপর্ণাকে ভালোবাসি। সে একজন ভালো মেয়ে।"
রায়বাহাদুর অভিজিতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। "ভালোবাসা! এসব ভালোবাসার নামে কিছুই হয় না। তুই আমাদের বংশের ছেলে। তোর জন্য আমি সব ঠিক করে রেখেছি। তোর বিয়ে হবে এক জমিদার বাড়ির মেয়ের সঙ্গে। তুই এই সব ভুলে যা।"
অভিজিৎ প্রতিবাদ করল। "কিন্তু বাবা, আমি তাকে ছেড়ে দিতে পারি না।"
রায়বাহাদুর রেগে গেলেন। "যদি না পারিস, তাহলে তোর জন্য আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়াই ভালো।"
এই ঘটনার পর অভিজিতের মনটা ভেঙে গেল। সে বুঝতে পারল, তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সে জানত না কী করবে। সে অভ্রকে সব কিছু বলল।
অভ্র বলল, "আমার মনে হচ্ছে কেউ এই কাজটা করেছে। সে চায় না তুই আর অপর্ণা একসঙ্গে থাকিস।"
"কে হতে পারে?" - অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল।
"আমি জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো রহস্য আছে। হয়তো কোনো শত্রু আছে, যে আমাদের সর্বনাশ করতে চায়।" - অভ্র বলল।
অভিজিৎ ঠিক করল, সে অপর্ণার কাছে যাবে। তাকে সব কিছু বলবে। সে জমিদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তার হাতে এখনো অপর্ণার জন্য লেখা সেই চিঠিটা।
সে যখন অপর্ণার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তখন তার সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়ির ভেতরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনি একজন পুরোনো ব্যবসায়ী, যার সঙ্গে রায়বাহাদুরের ভালো সম্পর্ক আছে। "অভিজিৎ, কোথায় যাচ্ছিস?" - ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
"আমি কিছু কাজ আছে, যাচ্ছি।" - অভিজিৎ বলল।
"আমি জানি তুই কোথায় যাচ্ছিস। আমি রায়বাহাদুরের একজন পুরোনো বন্ধু। তুই যদি অপর্ণার কাছে যাস, তাহলে তার সর্বনাশ হবে। রায়বাহাদুর তাকে এই গ্রামের থেকে বের করে দেবেন।" - ভদ্রলোক বললেন।
অভিজিতের বুকে একটা পাথর চাপা পড়ল। সে বুঝতে পারল, তার বাবা অপর্ণাকে ভয় দেখাচ্ছেন। সে যদি অপর্ণার কাছে যায়, তাহলে তার স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাবে। সে ফিরে গেল।
পঞ্চম অধ্যায়: রহস্যময় দুর্ঘটনা
অভিজিৎ ফিরে এসে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে দিল। তার মনে তখন এক অদ্ভুত ঝড় বইছে। একদিকে অপর্ণার প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে তার বাবার হুমকি এবং সেই রহস্যময় কাগজের টুকরা। কে এটা করল? কেন করল? অভিজিৎ অভ্রকে ফোন করল।
"অভ্র, আমি এখন কী করব? বাবা আমাকে অপর্ণার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন, আর ওই ভদ্রলোক বলছেন যদি আমি অপর্ণার কাছে যাই তাহলে বাবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার সর্বনাশ করা হবে।"
অভ্র অভিজিৎকে শান্ত হতে বলল। "শোন, আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র আছে। আমাদের কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, যে এই কাজটা করেছে। আর যদি সেটা করা যায়, তাহলেই আমরা তোর বাবাকে আসল সত্যটা জানাতে পারব।"
অভিজিৎ বলল, "কিন্তু কীভাবে?"
অভ্র বলল, "আমার এক বন্ধু আছে, শহরে গোয়েন্দার কাজ করে। তাকে দিয়ে এই ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।"
অভিজিৎ অভ্রর কথা শুনে আশার আলো দেখতে পেল। "তাহলে আর দেরি করিস না। ওকে এখনই সবটা বল।"
পরের দিন অভ্র সেই গোয়েন্দা বন্ধুকে নিয়ে এলো। তার নাম রঞ্জন। রঞ্জন খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। সে সবটা শুনল। "আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে। এই ধরনের কাজ সাধারণত এমন কেউ করে, যে আপনাদের পরিবারের খুব কাছের কেউ।"
অভিজিৎ আর অভ্র একে অপরের দিকে তাকাল। কে হতে পারে?
রঞ্জন বলল, "আমাদেরকে প্রথমে জানতে হবে কে এই কাগজের টুকরাটা ছড়িয়েছে। তার পেছনে কে আছে? আর যদি সেটা জানতে পারি, তাহলেই আমরা আসল রহস্যের সমাধান করতে পারব।"
রঞ্জন তার কাজ শুরু করল। সে প্রথমেই কিছু পুরাতন কাগজপত্র দেখতে চাইল। জমিদার বাড়ির পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে সে একটি চিঠি খুঁজে পেল। চিঠিটা অনেক পুরোনো, কিন্তু তাতে একটি ভয়ংকর সত্য লেখা আছে।
চিঠিটা ছিল রায়বাহাদুরের এক বন্ধুর লেখা। তাতে লেখা ছিল, "তোমার ছেলে অভিজিৎ যখন আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল, তখন তার সঙ্গে আমার মেয়ে অপর্ণার দেখা হয়েছিল। আমি জানি তুমি এই সম্পর্কটা মেনে নেবে না। কিন্তু আমি চাই তোমার ছেলে আমার মেয়েকে বিয়ে করুক।"
অভিজিতের মনে তখন হাজারো প্রশ্ন। এই চিঠির কী মানে? তার বাবা এই চিঠিটা কেন লুকিয়ে রেখেছিলেন?
রঞ্জন চিঠিটা দেখে বলল, "এই চিঠির সঙ্গে এই ঘটনার একটা সম্পর্ক আছে। আমি এখন বুঝতে পারছি, কেন এমন হচ্ছে।"
ঠিক তখনই তাদের ফোন এলো। "অভিজিৎ, তোমার বাবা... তিনি... তিনি আর নেই।"
অভিজিতের কানে বাজ পড়ল। তার বাবা মারা গেছেন? কীভাবে? তার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। সে অভ্রকে নিয়ে দ্রুত ছুটে গেল। জমিদার বাড়িতে এক বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। রায়বাহাদুরের দেহটা পড়ে আছে, তার গলায় একটি দড়ি।
পুলিশ এলো। তারা এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু অভিজিৎ আর অভ্র এটা মেনে নিতে পারল না। "এটা আত্মহত্যা হতে পারে না। আমার বাবা কেন আত্মহত্যা করবেন?" - অভিজিৎ পুলিশকে জিজ্ঞেস করল।
পুলিশ বলল, "তার গলায় দড়ি ছিল। আমরা মনে করি তিনি নিজেই নিজেকে শেষ করেছেন।"
অভিজিৎ অভ্রকে বলল, "এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা খুন। আর এর পেছনে আছে সেই রহস্যময় চিঠি আর ওই লোকটা।"
অভ্র বলল, "কিন্তু কেন? কেন তোর বাবাকে খুন করা হলো?"
অভিজিতের মনে তখন শুধু একটাই কথা, "আমাকে এই খুনের রহস্যের সমাধান করতে হবে। আর এই সমাধানের সূত্র আছে ওই চিঠিতে।"
ষষ্ঠ অধ্যায়: রহস্যের কুণ্ডলী এবং এক অপ্রত্যাশিত বৈঠক
রায়বাহাদুরের মৃত্যুর পর জমিদার বাড়িতে নেমে এলো এক নিস্তব্ধতা। অভিজিতের কাঁধে যেন হঠাৎ করেই এক বিশাল বোঝা এসে পড়েছে। একদিকে বাবার মৃত্যুর শোক, অন্যদিকে সেই রহস্যময় খুনের যন্ত্রণাদায়ক উপলব্ধি। পুলিশ যখন রায়বাহাদুরের মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে ঘোষণা করল, তখন অভিজিৎ অভ্রকে নিয়ে এক গোপন বৈঠকে বসল।
"এটা আত্মহত্যা নয়, অভ্র। আমার মন বলছে এটা খুন। আর এর পেছনে আছে কোনো এক গভীর ষড়যন্ত্র। আমরা সেই রহস্যের সমাধান করব।"
অভ্র বলল, "কিন্তু কীভাবে? আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।"
অভিজিৎ তার পকেট থেকে পুরোনো চিঠিটা বের করল। "এই চিঠিটাই আমাদের একমাত্র সূত্র। রঞ্জন এই চিঠিটা খুঁজে বের করেছিল। এই চিঠিটা আমার বাবার এক বন্ধু লিখেছিল, যিনি তার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার নাম হচ্ছে সতীনাথ বাবু।"
অভ্র বলল, "সতীনাথ বাবু? তিনি তো আমাদেরই একজন পুরোনো ব্যবসায়ী বন্ধু! কিন্তু তার মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ের কথা কেন হবে? আর তোর বাবা কেন এই সম্পর্কটা মেনে নেবেন?"
অভিজিৎ বলল, "আমি জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। আমরা রঞ্জনের সঙ্গে কথা বলব।"
রঞ্জন তাদের সঙ্গে দেখা করল। "আমি এই চিঠিটা নিয়ে আরও কিছু অনুসন্ধান করেছি। সতীনাথ বাবুর মেয়ের নাম অপর্না। কিন্তু এটা তোমার অপর্ণা নয়। এই অপর্ণা হচ্ছে তার আরেক মেয়ে, যে অনেক দিন আগে মারা গেছে। আমার মনে হচ্ছে এই ঘটনাটা কোনো এক প্রতিশোধের সঙ্গে জড়িত।"
অভিজিতের মনে তখন এক নতুন প্রশ্ন। কেন প্রতিশোধ? আর কে প্রতিশোধ নিতে চায়?
এদিকে, অপর্ণা যখন রায়বাহাদুরের মৃত্যুর খবর পেল, তখন তার মনটা কেঁপে উঠল। সে জমিদার বাড়ির ছেলের সঙ্গে নিজের গোপন সম্পর্কের জন্য কিছুটা হলেও দায়ী মনে করল। তার মনে হলো, যদি অভিজিৎ তার সঙ্গে না মিশত, তাহলে হয়তো এই ঘটনা ঘটত না। সে অভিজিতের সঙ্গে দেখা করতে গেল।
তারা যখন দেখা করল, তখন অভিজিৎ অপর্ণাকে সব কিছু বলল। সেই চিঠি, সেই প্রতিশোধের কথা এবং রঞ্জনের অনুমান। অপর্ণা সবটা শুনে অবাক হল। সে অভিজিৎকে বলল, "আমি জানি না এই ঘটনা কেন ঘটছে, কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি তোমার পাশে আছি।"
অভিজিৎ তার হাত ধরল। "আমিও জানি না। কিন্তু এই রহস্যের সমাধান করতে হবে। আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে।"
ঠিক তখনই তাদের সামনে এক পুরোনো লোক এসে দাঁড়াল। সে একজন পুরোনো কর্মচারী, যার সঙ্গে রায়বাহাদুরের সম্পর্ক ভালো ছিল। "অভিজিৎ বাবু, আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। এটা খুন। আমি দেখেছি। সতীনাথ বাবু এই কাজটা করেছেন।"
অভিজিৎ আর অভ্র চমকে উঠল। "কী বলছেন?"
লোকটা বলল, "আমি দেখেছি। রায়বাহাদুর যখন মারা গেলেন, তখন সতীনাথ বাবু তার সঙ্গে ছিলেন। আমি দেখেছি তিনি রায়বাহাদুরকে কোনো একটা ওষুধ খাইয়েছিলেন।"
অভিজিতের বুকে একটা পাথর চাপা পড়ল। সে বুঝতে পারল, তার বাবার মৃত্যুর আসল কারণ কী। সে বুঝতে পারল, এটা কোনো প্রতিশোধ নয়, এটা একটা ষড়যন্ত্র।
সপ্তম অধ্যায়: অপর্ণার আত্মত্যাগ এবং সত্যের উন্মোচন
পুরোনো কর্মচারীর কথা শুনে অভিজিতের মনের সব জট খুলে গেল। সে অভ্র আর অপর্ণাকে নিয়ে রঞ্জনের কাছে গেল। সবটা শুনে রঞ্জন বলল, "আমাদের এখন প্রমাণ দরকার। এই প্রমাণ যদি না থাকে, তাহলে সতীনাথ বাবুকে ধরা যাবে না।"
অভিজিৎ বলল, "প্রমাণ আমরা নিয়ে আসব।"
তারা সতীনাথ বাবুর পুরোনো বাড়িটার খোঁজ নিল। বাড়িটা অনেকদিন ধরে তালাবন্ধ ছিল। অভিজিৎ আর অভ্র সেই বাড়িটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। অভ্র বলল, "আমরা কীভাবে ভেতরে যাব? তালা তো বন্ধ।"
অভিজিৎ বলল, "আমরা তালা ভাঙব।"
তারা তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে চারিদিকে ধুলো আর মাকড়সার জাল। তারা অনেক খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু কোনো প্রমাণ পেল না। অভিজিৎ হতাশ হয়ে বলল, "আমরা বোধহয় ভুল করলাম।"
ঠিক তখনই অপর্ণা ঘরের এক কোণে একটি ছোট ডায়েরি দেখতে পেল। ডায়েরিটা অনেক পুরোনো, কিন্তু তাতে সবকিছু লেখা আছে। ডায়েরিটা ছিল সতীনাথ বাবুর মেয়ের। তাতে লেখা আছে, "আমি অপর্ণা, সতীনাথ বাবুর মেয়ে। আমি অভিজিৎকে ভালোবাসতাম, কিন্তু তার বাবা এই সম্পর্কটা মেনে নেননি। তিনি আমাকে অপমান করেছিলেন।"
অভিজিৎ ডায়েরিটা পড়ছিল। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল, তার বাবা ভুল করেছিলেন। তিনি সতীনাথ বাবুর মেয়েকে অপমান করেছিলেন। সতীনাথ বাবু তার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।
ডায়েরিতে আরও লেখা ছিল, "আমি সতীনাথ বাবুর কাছে অনুরোধ করেছিলাম, যেন তিনি অভিজিৎকে আর তার পরিবারকে কষ্ট না দেন। কিন্তু তিনি আমার কথা শোনেননি। তিনি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।"
অভিজিৎ বুঝতে পারল, সতীনাথ বাবু তার বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। তিনি অভিজিৎকে যন্ত্রণা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি অভিজিতের বাবাকে খুন করে এবং তারপর সেই মিথ্যা খবর ছড়িয়ে অভিজিতের জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলতে চেয়েছিলেন।
ঠিক তখনই তাদের সামনে সতীনাথ বাবু এসে দাঁড়ালেন। তার হাতে একটি বন্দুক। "তোমরা এখানে কী করছ?" - তিনি রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
অভিজিৎ বলল, "আমরা আপনার ডায়েরিটা পেয়েছি। আমরা জানি আপনি কেন আমাদের বাবার সঙ্গে এমন করেছেন।"
সতীনাথ বাবু হাসলেন। "তোমরা কি ভাবছ? তোমরা আমাকে ধরতে পারবে? আমি সবটা শেষ করে দেব।"
তিনি বন্দুকটা অভিজিতের দিকে তাক করলেন। ঠিক তখনই অপর্ণা তার সামনে এসে দাঁড়াল। "দাদা, আপনি ভুল করছেন। আপনি প্রতিশোধের জন্য একজন নির্দোষ মানুষকে মারতে চাইছেন।"
সতীনাথ বাবু বললেন, "আমি কোনো নির্দোষকে মারছি না। আমি সেই মানুষটাকে শাস্তি দিচ্ছি, যে আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়েছিল।"
অভিজিৎ বলল, "আপনি যাকে খুন করছেন, তিনি তার বাবার মতোই। তিনি একজন ভালো মানুষ।"
সতীনাথ বাবু তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তিনি বন্দুকটা অভিজিতের দিকে তাক করলেন। ঠিক তখনই অপর্ণা ঝাঁপিয়ে পড়ল। সতীনাথ বাবু গুলি চালালেন। গুলিটা অভিজিতের গায়ে না লেগে অপর্ণার গায়ে লাগল।
অপর্ণা মাটিতে পড়ে গেল। তার শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। অভিজিৎ তার কাছে ছুটে গেল। "অপর্ণা! কী হয়েছে?"
অপর্ণা হাসল। "আমি... আমি তোমার জীবন বাঁচালাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
অভিজিতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে অপর্ণাকে নিজের কোলে তুলে নিল। ঠিক তখনই পুলিশ এলো। তারা সতীনাথ বাবুকে গ্রেপ্তার করল।
অভিজিৎ অপর্ণাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। ডাক্তার বলল, "আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু ওর অবস্থা খুব খারাপ।"
অভিজিৎ অপর্ণার কাছে গেল। তার হাত ধরল। "অপর্ণা, তুমি কেন এমন করলে?"
অপর্ণা বলল, "আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।"
অভিজিৎ হাসল। "আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। আমি তোমাকে কোনোদিনও ছেড়ে দেব না।"
অষ্টম অধ্যায়: ক্ষত, ক্ষমা এবং এক নতুন ভোর
অপর্ণাকে নিয়ে অভিজিৎ আর অভ্রর ছুটে চলার সেই দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে দুঃস্বপ্নের দিন হয়ে রইল। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ নিজেকে বোঝাতে পারছিল না। অপর্ণা কেন এমন করল? কেন সে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলল? তার ভালোবাসার এই গভীরতা অভিজিৎকে ভেতরে ভেতরে আরও বেশি করে কষ্ট দিচ্ছিল।
সার্জন যখন বেরিয়ে এলেন, তখন অভিজিতের বুক কেঁপে উঠল। "ডাক্তার, অপর্ণা কেমন আছে?"
ডাক্তার শান্তভাবে বললেন, "রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। গুলিটা খুব গভীরভাবে আঘাত করেছে। আমরা চেষ্টা করছি। তবে সবটা এখন ঈশ্বরের হাতে।"
অভিজিতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার মনে হলো, সে যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলেছে। তার বাবা, তার ভালোবাসা, তার স্বপ্ন, সব কিছু যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অভ্র তার কাঁধে হাত রাখল। "আরে বন্ধু, ভেঙে পড়িস না। অপর্ণা ফিরে আসবে।"
রাতটা যেন অনন্তকাল ধরে চলল। পরের দিন সকালে যখন ডাক্তার এসে বলল, "রোগী এখন বিপদমুক্ত," তখন অভিজিতের বুক থেকে যেন এক বিশাল পাথর নেমে গেল। সে দ্রুত অপর্ণার রুমে গেল। অপর্ণা ঘুমিয়ে ছিল। তার মুখে একটা মৃদু হাসি ছিল। অভিজিৎ তার হাত ধরল। সে তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে তার বাবাকে ক্ষমা করবে, সে অপর্ণাকে ভালোবাসবে, এবং সে তাদের জীবনটাকে নতুন করে শুরু করবে।
অপর্ণা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। অভিজিৎ প্রতিদিন তার কাছে যেত, গল্প করত, আর তার যত্ন নিত। তাদের ভালোবাসা আরও গভীর হলো। সতীনাথ বাবুকে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল। তার অপরাধ ছিল প্রমাণ সাপেক্ষে খুন ও ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা। সতীনাথ বাবু নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ছিলেন। তিনি অভিজিতের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অভিজিৎ তাকে ক্ষমা করে দিল। সে বুঝেছিল, প্রতিশোধ কাউকে শান্তি দেয় না।
অভিজিৎ এবং অভ্র মিলে জমিদার বাড়ির সব পুরোনো কাগজ-পত্র ঘাঁটতে শুরু করল। তারা আবিষ্কার করল, অভিজিতের বাবাও একটা সময় সতীনাথ বাবুর মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সমাজের চাপে তিনি তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। রায়বাহাদুর তার সেই ভুলের জন্য অনুতপ্ত ছিলেন এবং সে কারণেই তিনি গোপনে সেই চিঠিটা রেখেছিলেন। রায়বাহাদুর চেয়েছিলেন, তার ছেলে যেন সেই ভুলটা না করে।
অভিজিৎ এবার বুঝতে পারল তার বাবার নীরব ভালোবাসার গভীরতা। তার চোখে তখন জল গড়িয়ে পড়ল। সে তার বাবাকে ক্ষমা করে দিল।
একদিন, অভিজিৎ অপর্ণাকে বলল, "আমি আর জমিদার বাড়িতে ফিরে যাব না। আমি আমার বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করব। আমরা আমাদের জীবনটা নতুন করে শুরু করব।"
অপর্ণা হাসল। "আমি তোমার পাশে আছি।"
অভিজিৎ তার সব সম্পত্তি গ্রামের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে ভাগ করে দিল। সে তার বাবার পুরোনো স্কুলটা পুনরায় চালু করল। অভ্র তার পাশে এসে দাঁড়াল। তারা দুজনেই মিলে সেই স্কুলটাকে একটি নতুন জীবন দিল।
এরপর, অভিজিৎ আর অপর্ণা একসঙ্গে তাদের নতুন জীবন শুরু করল। তারা সমাজের বাধা-বিপত্তিকে পেছনে ফেলে দিল। তাদের ভালোবাসা ছিল এক নতুন ভোরের মতো। তাদের গল্পটা ছিল এক অসম্পূর্ণ গল্পের মতো, যা ধীরে ধীরে পূর্ণতা পেয়েছিল। তাদের ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের গল্পটা ছিল এক সত্যিকারের উপন্যাসের মতো।